
খোদ কলকাতায় বসে লিভ ইন থেকে সমকামিতা সবেতেই সাহসিনী ললিতা। রিভিলিং পোশাক, আগুনে রূপ, সাহসী দৃশ্যে অভিনয়, বিদ্যাগত যোগ্যতায় প্রথমা, চোস্ত ইংরেজি নিয়ে ছয়ের দশকের বাংলাছবির মেমসাহেব হয়ে এলেন ললিতা। ললিতা চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের বাৎসরিকে নায়িকাকে নিয়ে লিখছেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের ফিল্মোগ্রাফি সম্পর্কে নিজে বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ‘আমার সময়ে সুচিত্রা সাবিত্রী সন্ধ্যা রায় কিছু ক্ষেত্রে সুপ্রিয়াও যে ধরনের নিটোল ঘরোয়া বাঙালী বউ মেয়ের চরিত্র করতেন সেগুলো আমার লুকসের সঙ্গে যেতনা। তাই হয়তো ছবিতে সহনায়িকা হয়ে গেলাম।’ এই বিদেশি লুকের জন্যই ললিতা বিদেশির রোলে টাইপ কাস্ট হয়ে গেলেন। কিন্তু মেম দের রোল করতেন অসাধারন। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গীর বিদেশি প্রেমিকা হতে ললিতা ছাড়া আর কে পারত? মাত্র চার বছর বয়সে মাতৃহারা হন ললিতা। তখন অবশ্য নাম রুণু। আসল নাম রুণু। পিতা মায়ের মমতা ভালোবাসায় ভরিয়ে দেন। পিতা আর্মিতে চাকরি করতেন তাই রুণুর ছোটবেলা কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। কখনও পটনা, কখনও মিরাটে। এরপর চলে আসেন সবাই দক্ষিণ কলকাতার ম্যাডক্স স্কোয়ারের কাছে রিচি রোডে। তখন সব বাড়িতেই খুব সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থাকত। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বিয়ে করেছিলেন সোমু মুখোপাধ্যায়কে। ললিতা প্রাইভেটে স্কুল ফাইনালে প্রথম হওয়া ছাত্রী ছিলেন। শ্বশুরবাড়ির তাগিদে কিছুদিন পরই চলে গেলেন বিলেতে। লন্ডনে স্কুলে ভর্তি হলেন শাশুড়ির পরামর্শে। চলতে লাগল পড়াশোনা। তারই মধ্যে খুব অল্প বয়সেই দুই ছেলের মা হলেন ললিতা। সেই বিলেতের স্বামী সংসার আর সামলে উঠতে পারলেননা। বিচ্ছেদ। দুই পুত্রসহ ফিরে এলেন কলকাতায়।
ভর্তি হলেন লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে। স্কলারশিপ নিয়ে পাশ করলেন। স্নাতকোত্তরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। পড়াশুনোয় ললিতা সবসময় হতেন প্রথম। নামই হয়ে গেছিল ফার্স্ট গার্ল। স্নাতকোত্তর কমপ্লিট না করেই বাড়ির অমতে স্কুলে পড়ানোয় যোগ দেন ললিতা। ইংরেজিতে দক্ষ ললিতা চট্টোপাধ্যায় সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকাও ছিলেন। শুধু তাই নয় সাঁতার সহ নানা আউটডোর গেমে ললিতা ছিলেন প্রথমা। সঙ্গে ছিলেন দারুন গায়িকা। নায়িকা নয় সুচিত্রা সেনের মতো আগে গায়িকারই অডিশন দেন ললিতা। রেডিওতে ‘ডাকঘর’ নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন মেয়েবেলায়। পরে রেডিওতে করেছেন গানের অনুষ্ঠান। এর মধ্যে কানন দেবীর প্রযোজনায় জীবনের প্রথম ছবি শ্রীমতী পিকচার্সের ‘অনন্যা’ করে ফেলেছেন ললিতা। তখন সাত আট বছরের রুণু। ললিতা চ্যাটার্জ্জীর দাদার স্ত্রী ছিলেন খ্যাতনামা নায়িকা কাবেরী বসু। ললিতা ছিলেন অসম্ভব উত্তম কুমারের ফ্যান। তাই যখন কাবেরী উত্তম নায়িকা হয়ে ‘রাইকমল’ করছেন তখন একদিন ননদ রুণুকে নিয়ে গেলেন ‘রাইকমল’র সেটে উত্তমকুমারকে দেখতে চাইতেন ললিতা। প্রথম উত্তমকুমারকে সামনাসামনি দেখলেন ললিতা। ললিতার আগুন রুপে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান মহানায়ক। ললিতাকে তাঁর পরের ছবি ‘বিভাস’এ নায়িকা হবার অফার দেন। উত্তমকুমার বলেন সেই শ্রীমতী পিকচার্সের ‘অনন্যা’ ছবি টেনে, ‘রুণু ছোটবেলায় তো অভিনয় করেছ। বড় হয়ে আবারো করোনা। তোমার চেহারা এত সুন্দর।এরা নতুন একটা মুখ খুঁজছে। কাউকেই পছন্দ হচ্ছেনা। তুমি করলে ভালো হয়।’ উত্তমকুমার বলেছেন না করে কার সাধ্য। ‘বিভাস’-এর পর দ্বিতীয় ছবির সেটে কাজের ফাঁকে ডুবেছিলেন ভ্লাদিমির নোবোকভের ‘লোলিটা’-য়। কয়েক জন সাংবাদিক এসে রুণুর কাছে জানতে চান, তাঁকে কী নামে ডাকবেন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, ললিতা! ব্যস সেই থেকে ললিতা চট্টোপাধ্যায়। এরপর আরও ছবি উত্তমের সঙ্গে ‘মোমের আলো’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘জয় জয়ন্তী’। এছাড়াও ‘সমান্তরাল’, ‘চিঠি’, ‘মেম সাহেব’, ‘মুক্তিস্নান’। এরমধ্যে চলে এসছেন দেশপ্রিয় পার্কের সাহেবি ভাড়া বাড়িতে।
ষাটের দশকে বাংলা ছবিতে কাজ শুরু করার পর মাঝে দুই ছেলেকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন মুম্বাই। বলিউডে পা রাখেন ললিতা। ‘ভিক্টোরিয়া নং জিরো থ্রি’, ‘তুম হাসিন ম্যায় জাওয়ান’, ‘তালাস’, ‘রাত আন্ধেরি থি’, ‘পুস্পাঞ্জলি’ অনেক গুলি বলিউড ছবি করেছেন। সঙ্গে পেয়েছেন নায়ক ফিরোজ খান, মনোজ কুমার, রাজেশ খান্নার মতো নায়কদের। বলিউডে দশ বছর কাটিয়ে কলকাতা ফিরে এলেও বাংলা ছবিতে উল্লেখযোগ্য রোল পাচ্ছিলেন না। তাই চলে গেলেন থিয়েটার যাত্রা করতে এবং সেখানে পেলেন বিশাল সম্মান নায়িকার সম্মান। এমন এমন সব পালা করেছেন যা যাত্রা ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য। ইন্দিরা গান্ধী থেকে ওফেলিয়ার মতো চরিত্র করেছেন। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর ঘোষ এদের অবদান অসীম ললিতার যাত্রা ক্যারিয়ারে। ‘তিন পয়সার পালা’, ‘ভারত জননী ইন্দিরা’, ‘ভগিণী নিবেদিতা’ যাত্রা করে ললিতা জীবনের সেরা স্বপ্নের দিন পান।
ললিতার সাংসারিক জীবন বৈচিত্র্যময়। বহুবার সংসার করেছেন। তিন তিন বার সংসার জীবন। তিন জন পুরুষ। প্রথম স্বামী সোমু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর বিয়ে করেন যাত্রার নায়ক পাহাড়ী ভট্টাচার্য্যকে। পাহাড়ী ভট্টাচার্য্য সদ্য ৩০ পেরনো তখন ললিতা ৪০-৪৫ পেরিয়েছেন। পাহাড়ী ভট্টাচার্য্য’র সঙ্গে ভাঙলো মিলনমেলা। এর মধ্যে বড় হয়ে গেছেন ললিতার সন্তানরা। পাহাড়ীর পর যে সঙ্গী ললিতার জীবনে এলেন তাঁর সঙ্গে বিয়ে করেননি। দীর্ঘদিনের সঙ্গী বন্ধু যার সঙ্গে লিভ ইন করতেন ললিতা। সেই তৃতীয় পুরুষ যখন চল্লিশে পড়েছেন তখন তিনি ৬১ বছরের ললিতার সঙ্গে লিভ ইন করেন। ইনি ছিলেন শেষ দিন অবধি ললিতার সঙ্গে। তিনি দেখভাল করতেন নায়িকার। তাঁর’ক বছর আগে প্রয়ান হয়। আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর ‘জোনাকি’ ছবির মুখ্য চরিত্র। ‘জোনাকি’ ললিতার জীবনে একটি সেরা ছবি যাতে ললিতার যুবক বয়ফ্রেন্ডের রোল করেছেন জিম সার্ভ। এছাড়াও আছেন রত্নাবলী, সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়। ললিতা যে সমাজের বেড়াজাল ভেঙেছেন বারংবার তার পরিচয় শেষ জীবনেও দিয়েছেন। এক সমকামী নারীর চরিত্রে ‘স্পর্শ, দ্য টাচ’ ছবিতে ললিতা। যে ছবি বাংলা ছবির সাহসী পদক্ষেপ। মাসি-বোনঝির সমকামী সম্পর্কের জটিল মনস্তত্বে ঘুরে বেড়ায় এই ছবির কাহিনী। মাসির চরিত্রে অভিনয় করেছেন ললিতা চট্টোপাধ্যায়। নিজের সম্বন্ধে আত্মমূল্যায়ণ করে বলেছেন, ‘যখন নায়িকা হতে এলাম সে সময় ইংরেজি বলা, বোল্ড পোশাক পরা মানেই ছিল ভিলেনের রোল। সেটাই হয়ে গেলাম। ভুলভাল চরিত্র নিয়ে ফেলতাম। অনেক ছবির অফার উত্তমকুমার নিয়ে আসতেন তা ফেলতে পারিনি। বলিউডেও তখন এক ব্যাপার। সতী সাবিত্রী নায়িকারই চল ছিল। এখন মনে হয় পড়াশোনার জগতে থাকলেই ভালো হত। আজকালকার ঋতুপর্ণ থেকে সৃজিত কেউ ডাকেনি । কাজ কম পাই তাই নিজের পছন্দের স্পোকেন ইংলিশের টিউশানি করে চালাই। যে বাড়িওয়ালার ছেলেকে কোলেপীঠে করে মানুষ করেছিলাম সে এই বাড়ি থেকে আমায় উচ্ছেদ করতে চায়।’ চোখ জলে ভেসে আসত ললিতার। ২০১৮ র ৯ই মে প্রয়াণ হয় ললিতা চট্টোপাধ্যায়ের। টালিগঞ্জ পাড়ার মেম হয়ে রয়ে যাবেন ললিতা।