
তেরো-চোদ্দ বছর হল মেদিনীপুর ছেড়ে এসেছেন কলকাতায় , কিন্তু পুজো আসলেই নিয়ম করে যাওয়া চাই সেখানে, এই প্রসঙ্গে অবশ্য মজা করে বললেন, “এই কথা শুনে কলকাতার লোকেরা রাগ করবেন, আমার ঠিক কলকাতার পুজো ভালো লাগে না! বিধাননগর, শরৎপল্লী (মেদিনীপুর)’তে আমি কোলে-পিঠে মানুষ হয়েছি তো সেই মফঃস্বলের পুজোর আমেজটাই আলাদা! এবছরও ব্যতিক্রম হবে না…”, হ্যাঁ, এটা ঠিক যতই বাংলা সিনেমার পরিচিত মুখ হয়ে উঠুন না কেন এই মানুষটা থাকবেন মাটির কাছাকাছি! এসভিএফ’র মিটিং রুমের টেবিলে রাখা কফির কাপ ও মারি বিস্কুট হাতে নিয়েই সদ্য ‘ধনঞ্জয়’র চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসা অনির্বাণ ভট্টাচার্য মুখোমুখি হলেন আমাদের সাথে…
বাংলার এই মুহূর্তে অন্যতম মেথড অ্যাক্টর তুমি এবং এর সাথে এখন আরেকটা বিশেষণ যোগ হয়েছে ‘স্টাইলিশ’, সমর্থন করছ বিষয়টা?
অনির্বাণ- কিছুই বলার নেই,(কফিতে চুমুক দিয়ে) এসব তকমা বাইরে থেকে লোকজন দেন, সমর্থন করি না ব্যাপারটা কারণ আমি খুব সাধারণ জামা-কাপড় পরি, রোদ থাকলে বড়জোর একটা সানগ্লাস, সেটাও আহামরি কিছু না। আমার কোন স্টাইল স্টেটমেন্ট নেই, হতে পারে তাঁরা আমার অভিনয়ের জায়গা থেকে স্টাইলিশ বলে থাকেন। আমি সেটে গেলে খুব শান্ত থাকি। ঠাট্টা, ইয়ার্কি, চিৎকার ,চ্যাঁচামেচি করি না… চুপচাপ থাকি সেখান থেকে মানুষের ধারণা হয়েছে আমি বোধহয় মেথড অ্যাক্টিং করি আসলে আমি কাজটা মোটামুটি সিরিয়াসলি করার চেষ্টা করি। আমাদের দেশে সেরকম কোন মেথড অ্যাক্টিং’র স্কুল নেই তাই কাউকে মেথড অ্যাক্টর বললে সম্পূর্ণভাবে সেটা ঠিক না। স্টানিসস্লাভাস্কি’র বই মাঝে মাঝে ফলো করি ঠিকই কিন্তু আমাদের থিয়েটার বা সিনেমাতে সেটা যায় না আর আমি প্রথম থেকে বুঝে গেছিলাম অভিনয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে গেলে আমাকে পরিশ্রম করতে হবে, সেই জায়গা থেকে মানুষরা এটা বলছেন। এই তকমাটা শুনতে ভালো লাগলেও এটা পুরোপুরি মেথড অ্যাক্টিং নয় !
যে মানুষটার চরিত্র করলে সে তো বেঁচে নেই আর যেটুকু ভিডিও ডকুমেন্টেশন রয়েছে সেটা সামান্যই, তবে ধনঞ্জয়কে নিয়ে পড়াশুনা কিভাবে করলে?
অনির্বাণ- প্রথমত যে ভিডিওটি রয়েছে এমএস সত্তু’র “রাইট টু লিভ”, সেটা অনেকবার দেখেছি, আর দেখো অ্যাক্টিংটা কিন্তু নকল করা বা মিমিক করা নয়, অ্যাক্টিং হল রিক্রিয়েটিং বা রিবিল্ড দি ক্যারেক্টার থ্রু ইউরসেলফ। আমি কখনো ভাবি নি যে ধনঞ্জয়কে নকল করতে হবে, বাঁকুড়াতে যাওয়া, ওঁদের গ্রাম্য জীবনটাকে কাছ থেকে দেখা, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে যাওয়া সেই ফাঁসির মঞ্চ দেখা, সেই সেল দেখা যেখানে ১৪ বছর ছিল ধনঞ্জয়, এই কেসের সমস্ত নথিপত্র পড়া সেখানে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল দেবাশিষ সেনগুপ্ত, পরমেশ্বর গোস্বামী, প্রবাল চৌধুরী’র “আদালত মিডিয়া সমাজ এবং ধনঞ্জয়ের ফাঁসি” ,সেটা তথ্যের জায়গা থেকে কিন্তু নিজেকে তৈরি করতে সেই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। তবে আমি চেয়েছিলাম এইগুলো করতে শুধুমাত্র অভিনয়ের জন্য নয় নিজের জীবনেও অনেক অভিজ্ঞতা জমা হয়।
এই মুহূর্তে এই বদ্ধ ঘরে তুমি আর ধনঞ্জয়! কি প্রশ্ন করবে তাঁকে?
অনির্বাণ- যে আপনি কি করেছিলেন আর কি করেন নি?
পরিচালক বলছিলেন তোমার উপর একটা দুর্বলতা আছে, সেটার প্রভাব কি সেটে ছিল?
অনির্বাণ- নাহ, দেখো ওনার আমার প্রতি দুর্বলতা অভিনয়কে নিয়ে মানে আমি মন দিয়ে কাজ করি, চেষ্টা করি যে দায়িত্বটা দেওয়া হয় সেটা ১০০ শতাংশ, ২০০ শতাংশ দেওয়ার এবং পরিচালক যেটা চাইছেন সেটা মাথায় রেখে পরিশ্রম করা,আমার মনে হয় সেটা আমি করতে পেরেছি বলেই অরিন্দমদা’র আমার প্রতি আস্থা, স্নেহ এবং দুর্বলতা তৈরি হয়েছে, সেটে দুর্বলতার কোন জায়গা নেই।
একটু ভয় কি লাগছে, এতো বিতর্কিত সিনেমা আর কয়েকদিনেই রিলিজ…
অনির্বাণ- একটু টেনশেন হচ্ছে! ভয় কেন পাব? আমি তো কোন অন্যায় কাজ করি নি! ধনঞ্জয়ের যখন ফাঁসি হয় তখন থেকেই এটা বিতর্কিত বিষয়, আর তখনই সম্ভাবনা দেখা গেছিল এই কেসে কিছু অসঙ্গতি আছে, সেই বিষয় নিয়ে যখন আমরা সামনে এসছি নানা মানুষ নানাভাবে রিয়াক্ট করছেন (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) সেটা একটা টেনশেন ক্রিয়েট করছে ঠিকই ভয় একদম নেই! ধনঞ্জয় কেন করেছি, কিভাবে করেছি সেটা নিয়ে আমার মনে কোন সংশয় নেই। রাম গোপাল ভার্মা’র সিনেমাতে অভিনেতা কাসভের রোল করেছে… তো? আমাদের কাজ চরিত্রে প্রাণদান করা। হ্যাঁ, টেনশেন হচ্ছে এতোজন মানুষের এতোদিনের পরিশ্রম সামনে আসতে চলেছে, আমরা বলছি না যে, ছবিকে ভালো বলতেই হবে বা ঠিক বলতেই হবে এমনকি এটা একটা ঠিক বা ভুলের ছবি না এটা একটা সম্ভাবনার ছবি যেখানে কিছু প্রশ্ন রাখা হয়েছে এবং সেগুলো কাল্পনিক নয়, প্রমানের ভিত্তিতেই রয়েছে।
কিছু মানুষ তো এরকমও বলছে যে একজন রেপিস্টকে হিরো হিসেবে দেখানোর কোন মানে নেই! কি বলবে তাঁদের?
অনির্বাণ- আমার কথা হচ্ছে, সিনেমাটা না দেখে ওঁরা কেন দাবি করছেন যে আমরা ধনঞ্জয়কে ‘হিরো’ বানাচ্ছি!!! আমরা বলছি যে, ফাঁসি হয়েছিল সেই তদন্তে গরমিল ছিল সেটাও বলছি প্রমানের ভিত্তিতে, আদালত বা আইন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোন কথা নেই। এটা পরিষ্কার মাথায় বুঝতে হবে আদালত সেই তথ্যপ্রমানের ভিত্তিতে রায় দেন যেটা আদালতের সামনে আসে। এবার তদন্তে নানারকম অসঙ্গতি ছিল, সেই প্রমান আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! তদন্তের পেপার বুক কালেক্ট করা যায়, যাঁরা এটা নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁরা এই পেপারবুক হাইকোর্ট থেকে সংগ্রহ করে খতিয়ে দেখেছেন। এখন যাঁরা ঐ কথাগুলো বলছেন তাঁরা সেটা খতিয়ে দেখতে পারেন এখন আমরা সেই তথ্য প্রমানগুলোকে একজোট করে সিনেমাটা বানিয়েছি, আমাদের মনে হয়েছে ধনঞ্জয় নির্দোষ! আবার বলছি ‘মনে হয়েছে’ , এটা বলছি না যে আমরা জানি ধনঞ্জয় নির্দোষ! এবার হিরো বানানো হচ্ছে বলে দাবি করা মানুষরা কি এই তথ্যগুলো কি জানেন?? যদি নাই জানেন এটা বলছেন কেন? ইচ্ছে হয়েছে বলে দিয়েছে!!
প্রথম যখন এই রোলটা করবে পরিবার বা বন্ধুমহলে জানাও, তাঁদের কি বক্তব্য ছিল?
অনির্বাণ- কিছুই বলে নি! বলেছিল, কোন ধনঞ্জয়? যার ফাঁসি হয়েছিল, আমি বললাম, হ্যাঁ! ব্যস! (পিঠ সোজা করে) আমার পরিবার বা বন্ধুমহলে ঐ ধরনের সাব-স্ট্যান্ডার্ড মানুষরা নেই যারা আপত্তি জানাবে বা বলবে, এমা ধনঞ্জয় করবি !!
মেদিনীপুরের ছেলে মানেই উচ্চারণ দোষ থাকবে, সেই ধারণা ভুল
অনির্বাণ- একদম পক্ষে!
সিনেমা বছরে যতগুলোই আসুক না কেন থিয়েটার ছাড়বে না তুমি…
অনির্বাণ- হম, পক্ষে।
বড় পর্দায় ভিলেনকে ঘুষি মেরে আকাশ-ভ্রমণ করাতে দেখতে পাওয়া যাবে না তোমাকে!
অনির্বাণ- (একটু ভেবে) বিপক্ষে।
সোশ্যাল সাইটে সময় নষ্ট পছন্দ করো না তুমি
অনির্বাণ- পক্ষে।
ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয় দক্ষতা দিয়ে লিড রোলে আসা যায় তার জন্য কোন ইনফ্লুয়েন্সের দরকার পড়ে না।
অনির্বাণ- পক্ষে।
ইতিমধ্যে তোমার মহিলা ভক্তের সংখ্যা অনেক, ধনঞ্জয়ের পরেই তো পুজো আসছে! তাহলে সেই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হবে স্বাভাবিক ভাবে…
অনির্বাণ- নাহ ! পুরো উল্টো হবে, এরপর তো মহিলা মহলটা সরে যাবে !
কিন্তু তোমার ক্রেজটা তোমার অভিনয়ের জন্যই!
অনির্বাণ- (কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়েই) মানে? মহিলারা কবে থেকে অভিনেতার প্রতি আকৃষ্ট হল (হাসি) ! তাঁরা তো শাহরুখ,সলমান এঁদের ফ্যান হন! যদি এরকমটাই হয় আমার তো ভালোই লাগবে কোন সন্দেহ নেই (হাসি)…
এই সিনেমার পর তো তোমাকে ঘিরে ভিড় বাড়বেই…
অনির্বাণ- কোন ভিড় বাড়বে না গো…আমি এই ইন্টারভিউ শেষ করে এখুনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব একটা লোকও আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে না তুমি তো অমুক, তুমি তো তসুক!! এগুলো খানিকটা সেলফ ক্রিয়েটেডও হয়। আমি মাটির ভাঁড়ে চা খেতে ভালোবাসি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা’র দোকানে আড্ডা মারতে ভালবাসি, আমি রাস্তার ছেলে, আই অলওয়েজ এনজয় দি স্ট্রিট লাইফ অফ কলকাতা, মেদিনীপুর!
বছর দুই পর রাস্তা দিয়েই হেঁটে যাচ্ছ, পেছন থেকে কেউ ‘ধনঞ্জয়’ বলে ডাকলো, পেছন ফিরে তাকাবে?
অনির্বাণ- হ্যাঁ, অবশ্যই তাকাবো…আমি চাই ধনঞ্জয়কে আমার চেহারাতে নয় আমাদের ছবি দেখে চিনুক…
দেখুন ট্রেলার :
প্রশ্নের ওপারে- শুভদীপ কাজলী (এডিটর)।