
একটি কাল্পনিক দৃশ্য —-
(মাঝ আকাশে বিমান, তাতে ফরেন লিকার হাতে চার ভদ্রলোক – তামিল, মারাঠি, গুজরাটি, বাঙালি)
তামিল – কাবালিতে আমি অভিনয় করলাম না বলেই তো রজনীকান্ত পেল সুযোগটা।
মারাঠি – (আবেগতাড়িত হয়ে) শচীনকে যদি একবার কাছ থেকে দেখতে পেতাম….
গুজরাটি – ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতেছে , হেব্বি খুশি হয়েছি।
বাঙালি – চোপ শালা! (চেঁচিয়ে) এই পাইলট, সরে যা, প্লেনটা এবার আমিই চালাব!
তারপর থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বিমানে আর বাঙালিদের মদ দেবে না কোনও বিমান সংস্থা!
কী? বাঙালিদের ‘মদ্যপানের বিরুদ্ধে যারা, তাদের মাথায় পড়ুক বাজ !’ – ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ সিনেমায় উত্তমকুমার ঠিকই বলেছিলেন! বাঙালি তো আমোদপ্রিয় (পড়ুন আ-‘মদ’ প্রিয়) জাতি, তা আহ্লাদে একটু গলা ভেজাবে না, তা আবার হয় নাকি! তবে শুধুমাত্র আহ্লাদে তো নয়, ‘বেদনার বালুচরে’ এখনও বহু বাঙালি ভগ্নহৃদয় প্রেমিকের কাছে দেবদাস কিন্তু আইকন। পরিসংখ্যান বলছে, বাঙালি সাহিত্যিকদের একই সাহিত্যরচনার উপর নির্মিত সিনেমা-সংখ্যার নিরিখে শরৎচন্দ্রের দেবদাসই টপে। শুধুমাত্র সৃষ্টি কেন? কয়েকজন স্রষ্টার নামও তো মনে পড়ছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরীশ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সৃজনশীলতার অফুরান প্রাণশক্তি বোতলবন্দি ছিল বললে বোধ হয় ভুল কিছু বলা হবে না। তবে, একটি সন্দিহান প্রশ্ন আমার মনে উঁকি মারছে এবিষয়ে। যদি এই স্রষ্টাদের সৃজনশীলতার রহস্য শুধুমাত্র সুরার বোতলেই আবদ্ধ থাকত, তাহলে এতদিনে বঙ্গদেশ, বিশেষত শুঁড়িখানার আশেপাশের অঞ্চল লক্ষ লক্ষ গিরীশ ঘোষ কিংবা মধুসূদনে ছেয়ে যেত না কি? বোতলের সঙ্গে বেতাল হতে কোনও উপলক্ষ লাগেনা বাঙালির। ‘বিপিনবাবুর কারনসুধা’ -ঘটিত বোতলকাহিনী নিশ্চয়ই স্মৃতিতে এখনও অমলিন?
আচ্ছা, ‘বোতল’ শব্দটা শুনলে বাঙালি প্রথমেই কেন মদের গন্ধ পায় বলুন দেখি? কত কিছুই তো থাকতে পারে বোতলে – দুধ, ওষুধ, জ্যাম, জেলি, আচার, কোল্ড ড্রিঙ্কস এবং আরও কত কী! আসলে বোতল আর মদ হরিহর আত্মার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুটি না হয়েও এরা সেরা জুটি, ঠিক যেমন হাতা-খুন্তি, হাঁড়ি-কড়া প্রভৃতি। কলেজ লাইফে তো এক অধ্যাপকের কাছে কবীরের সেই বিখ্যাত দোঁহাটা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ‘গো-রস লে গলি গলি ফিরে / মদিরা ঠাঁয়ে বিকায়ে’। আজকাল নাকি কলেজ ইউনিভার্সিটিতে একটু আধটু মদ না খেলে ঠিক ‘কুল’ হওয়া যায় না।
প্রথম স্টেজ : বিয়ার (ইহা মদ নহে, হোমিওপ্যাথি ঔষধ!)। এরপর দ্বিতীয় স্টেজ : পা পড়ল ‘রাম’ মন্দিরে। অনুপ জালোটার ভজনই এখানে জীবনের অ্যান্থেম – ‘বোলো রাম রাম রাম..’। এরপর ‘ধর হুইস্কি সোডা আর মুরগী মটন’!
সেই রাজা – মহারাজাদের সুরাপান থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলের ফরেন লিকার কিংবা হাড়িয়া, মহুয়া, তাড়ি – সবই বেশ জনপ্রিয়। ইংরেজ বণিকের আগমনের সাথে সাথে যে বিদেশী শিক্ষা ও মদের অনুপ্রবেশ ঘটল বাংলায়, যে উচ্ছৃঙ্খল মাদকাসক্তি বাঙালিকে চঞ্চল করে তুললো, তার তীব্র বিরোধীতা ফুটে ওঠে ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গাত্মক কবিতার ছত্রে ছত্রে –
“ধন্য রে বোতলবাসী, ধন্য লাল জল / ধন্য ধন্য বিলাতের সভ্যতা সকল”।
বাঙালিদের একটা অংশের কাছে তো শৌখিন গেলাসে ওয়াইন ঢেলে ফাইন ইভনিং কাটানো এখন একটা স্টেটাস সিম্বলও বটে। আবার, বিখ্যাত বাঙালি পরিচালকরাও আজকাল সিনেমায় গুনীজনদের বৈঠক মদ ছাড়া দেখানোর কথা প্রায় ভাবতেই পারে না।
বোতলাবলম্বী বাঙালীর ছোটবেলার চুক চুক শব্দটা আঠারো ছুঁতে না ছুঁতেই পরিবর্তিত হচ্ছে ঢক ঢকে। এবারে অবশ্য স্বাদটা খানিক তেতো। সদ্য যৌবনের উত্তেজনায় টগবগে যুবকের প্রথম পেগ সাঁটিয়ে দেওয়া তার কাছে যেমন এভারেস্ট জয়ের সমতুল্য, তেমনি বাবার বোতল থেকে ঝেপে গলায় দু’ঢোঁক ঢালা এক সাকসেসফুল মিশন। রঙীন সেই জগতে পাশের বাড়ির টুকুন তখন জয়, বীরু, গব্বর, কালিয়া – সব রোল একসঙ্গে প্লে করছে।
মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে লুকিয়ে চুরিয়ে গলা ভেজানো অপরাধসম হলেও উচ্চবিত্ত পরিবারে বিষয়টায় রাখঢাক কম। অনেক ক্ষেত্রে দুই প্রজন্মকে নির্দ্বিধায় একসাথে চুমুক দিতে দেখা যায়। তবে, দুই ক্ষেত্রেই কমন ফ্যাক্টর হল ফরেন লিকার।
দুই প্রজন্মের একসঙ্গে মদ্যপান করার প্রসঙ্গে মনে পড়ল – ঋষি কপূর তার আত্মজীবনী ‘খুল্লমখুল্লা’ : ঋষি কপূর আনসেন্সর্ড’ –এ লিখেছেন যে, বাবা রাজ কপূরের সঙ্গে বন্ধুর মত সম্পর্ক ছিল তাঁর, একসঙ্গে মদ্যপানও করতেন তাঁরা।
সম্প্রতি প্রযোজক-পরিচালক সত্রাজিৎ সেনের মাইকেল ছবির শ্যুটিং ফ্লোরেও ধরা পড়ল এমনই এক দৃশ্য – কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে বসে ড্রিঙ্ক করছেন অভিনেতা মীর। ছবিটি সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে মীর লেখেন –

ছবিতে মীর অভিনয় করছেন নাম ভূমিকায় (মাইকেল), সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রের নাম ময়ূরবাহন চট্টোপাধ্যায়, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় মীরের স্ত্রীর ভূমিকায় থাকছেন। এছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করছেন সায়নী দত্ত, সৌম্যজিৎ মজুমদার, অরিজিৎ দত্ত, কাঞ্চন মল্লিক, অরুণিমা ঘোষ ও তনুশ্রী চক্রবর্তী।
সবশেষে বলি, ছোটবেলায় পড়া জেলে ও বোতলবন্দি দৈত্যের গল্পে দৈত্যটিকে পুনরায় বোতলবন্দি করা গিয়েছিল বটে, কিন্তু মদের বোতলটি একবার খুললেই নেশাগ্রস্ত বাঙালিকে দৈত্যটা আরও মদত দিতেই থাকে। থুড়ি, দৈত্য বলে ভুল করলাম না তো? ভেতো বাঙালি মদ খেয়ে “মোদো” বাঙালি হয়ে যদি দু’দন্ড দুঃখ ভুলে থাকে,ক্রিয়েটিভ কিছু করে, তবে তা তো বাঙালি জাতির পক্ষেই মঙ্গলজনক। কিন্তু শাস্ত্রে বলেছে, ‘সর্বমত্যন্ত গর্হিতম্’ – সবকিছুই অতিরিক্ত করাটা গর্হিত কাজ। তাই লাগাম টেনে ধরুন। আপনার কয়েক মুহূর্তের দুঃখ ভুলে থাকাটা যেন সারা জীবনের মতো দুঃখ ভুলে থাকার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়! বোতলপ্রীতি যেন শেষকালে স্যালাইনের বোতল হিসেবে ত্রাতা না হয়ে ওঠে। দেশ ও দশের স্বার্থে আপনার মতও তাই নয় কি?